আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৮, ১৯: ১৪
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর মেয়র প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য বিএনপির সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। জামায়াতের প্রার্থী তাঁর মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। এই সিটিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের এখন দুজন প্রার্থী। এর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০-দলীয় জোটে এমন ঘটনা ঘটেনি। জোটের প্রধান দুই শরিক বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থী থাকায় এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা পাল্টে যেতে পারে বলে মনে করছেন দুই দলের স্থানীয় নেতারা।
শুধু ভোটের হিসাব নয়, স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থান দল দুটির জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপির নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক দুজন নেতা বলছেন, এটা সম্ভবত বিএনপিকে জামায়াত একটা ধাক্কা দিল। তাঁদের মতে, দীর্ঘদিন থেকে জামায়াতের সঙ্গে কিছুটা শিথিল সম্পর্ক চলছিল বিএনপির। কিন্তু সিলেটের ঘটনায় জামায়াতের ছাড় না দেওয়ার ঘটনাটি জাতীয় নির্বাচনে দলটির দর-কষাকষির স্পষ্ট ইঙ্গিত বলে মনে করা হচ্ছে। তা ছাড়া দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল, সিলেট নির্বাচনে তা প্রকাশ্যে চলে এল।
স্থানীয় নির্বাচন হলেও জামায়াতে ইসলামীর এ অবস্থানে বিস্মিত হয়েছেন বিএনপির অনেক নেতা। প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় আজ সোমবার দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা পরবর্তী করণীয় নিয়ে নিজেদের মধ্য আলোচনা করছেন। আবারও এ বিষয়টি নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে নেতারা কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন।
আজ সোমবার সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের ছিল শেষ দিন। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান জানিয়েছেন, এই নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী রয়েছেন সাতজন। এর মধ্যে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ও জামায়াতের প্রার্থীসহ কেউই তাঁদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আগামীকাল মঙ্গলবার প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে। এরপর শুরু হবে প্রচার-প্রচারণা। অবশ্য জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকায় দলটি দলীয় প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন না। তাঁকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে হবে।
আজ শেষ দিনে সিলেট নগর জামায়াতের আমির এহসানুল মাহবুব সিটি নির্বাচনে তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। ইতিমধ্যে এহসানুল মাহবুব নগরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় মতবিনিময়ও অব্যাহত রেখেছেন। এহসানুল মাহবুব কেন প্রার্থী হলেন, বিষয়টি সম্পর্কে প্রচারপত্রও বিলি করা হয় বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়। গত বৃহস্পতিবার রাতে সিলেটে ২০–দলীয় জোটের সভায় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। ওই সভায় জামায়াতের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। পরে জামায়াতকে ছাড়া কমিটি করা হয়। এ ছাড়া নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার জন্য মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। তিনিও তাঁর মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। যদিও কেন্দ্রীয় বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিএনপি ও ২০–দলীয় জোটের শরিক দল রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি নির্বাচনে একক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবে। কিন্তু সিলেটে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ও জামায়াতের স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার না করার ফলে নতুন একধরনের জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে বিএনপিকে।
সিলেটে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব হয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। জোটের বৈঠকে জামায়াতের কেউ আসেননি। আবার কেন্দ্রীয় বৈঠকে জামায়াত ছিল। সেখানে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় যে তিন সিটিতেই বিএনপির মনোনীত প্রার্থীই জোটের প্রার্থী। কিন্তু সিলেট জামায়াত তা মানছে না।’
সিলেট জামায়াতের এক নেতা গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, কেবল স্থানীয় সিদ্ধান্তে তারা নির্বাচন করছেন তা নয়। কেন্দ্রও বিষয়টি অবগত। তিনি বলেন, জামায়াতে দীর্ঘদিন কোনো বড় নির্বাচনে নেই। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দলটি সামনে আসছে। তাঁদের ভোটের বিষয়টিও এখন সামনে আসবে। রাজনীতিতে জামায়াতের অবস্থান যে কম নয়, সেটি দেখানোও একটা উদ্দেশ্য।
এ বিষয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, দলীয়ভাবে বিষয়টি সমাধানের জন্য কথাবার্তা চলছে। জামায়াতের প্রার্থীর বিষয়ে দলের ও জোটের নেতারা কথা বলছেন। এ বিষয়ে শিগগিরই একটি সুরাহা হবে। দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটিও সমাধান হয়ে যাবে। যদি বিদ্রোহী প্রার্থী কথা না শোনেন, তাহলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তো আছেই।
সম্প্রতি বিএনপির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ভারত সফরে যায়। প্রতিনিধিদলে ছিলেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির। ওই সফরে তাঁরা ভারতকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে বিএনপি তার আগের ‘ভারতবিরোধী’ অবস্থান থেকে সরে এসেছে। বিএনপির আগের অবস্থান ঠিক ছিল না। এ ছাড়া ওই সফরে জামায়াত নিয়ে বিএনপির নিজের অস্বস্তির বিষয়েও কথা বলেন বিএনপির নেতারা। এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে নেয়নি জামায়াত।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ফলে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। নিবন্ধন বাতিলের কারণে এই দলের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আর কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এই রায়ের পর বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব নির্বাচনের বেশির ভাগই জামায়াত বিএনপির একক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে। কোথাও কোনো ধরনের সমস্যা কিংবা দ্বিমত দেখা যায়নি। কাউন্সিলর পদে এবং কিছু ছোট পদ ছাড়া কখনো মেয়র পদ নিয়ে সমস্যা হয়নি। জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনের পর প্রথমবারের মতো বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো।
জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে চলা সহিংসতার কারণে জামায়াতের রাজনীতি আর মাঠে থাকেনি। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা সবাই আড়ালে চলে যান। এরপর বেশ কয়েকবার গুঞ্জন উঠেছিল জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ছে বিএনপি! যদিও সেই গুঞ্জন বাস্তবে রূপ নেয়নি। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতের নেতাদের শাস্তির বিষয়ে বিএনপির ‘নীরবতা’ দেখে জামায়াত তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে থাকে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর এই প্রথম বিএনপি-জামায়াত ‘দ্বন্দ্ব’ প্রকাশ্যে এল।
সিলেটে জামায়াতের প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার না করার বিষয়টি জাতীয় নির্বাচনে নিজেদের আসন বিষয়ে বিএনপিকে ছাড় না দেওয়ার ইঙ্গিত প্রকাশ করছে। জামায়াতের দলীয় নিবন্ধন না থাকায় দলটি জাতীয় নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থী দিতে পারবে না। ফলে জামায়াতের সামনে একটি সুযোগ বাকি থাকে, সেটি হলো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা। কিন্তু বিএনপি যদি জামায়াতের সঙ্গে আপস না করে কিংবা জামায়াতের চাওয়া অনুযায়ী আসন বরাদ্দ না দেয়, তাহলে জামায়াতের ভবিষ্যৎ কী হবে? এই চিন্তা থেকেই মূলত জামায়াত সিলেটে নিজেদের প্রার্থীকে প্রত্যাহার করেনি। জামায়াত এটাই জানান দিচ্ছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে হিসাবের সময় এসে গেছে।